গ্লুকোমা কি? এর কারন ও প্রকারভেদ, ঝুঁকি, লক্ষন এবং চিকিৎসা 


গ্লুকোমা চোখের অপটিক নার্ভের একটি অসুখ। এর কারণে অপটিক নার্ভের উপর প্রচুর চাপ পড়ে যা অপটিক নার্ভের ক্ষতি করতে পারে। অপটিক নার্ভ আমাদের চোখ থেকে ব্রেইনে সিগনাল পাঠায়। ব্রেইন সেই সিগনালকে চিত্রে রূপান্তরিত করে, যেটা আমরা দেখতে পাই। অপটিক নার্ভ ঠিকমত কাজ না করলে দৃষ্টিশক্তিতে সমস্যা শুরু হয়। এমনকি সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি হারানোরও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

গ্লুকোমা সব বয়সের মানুষদেরই হতে পারে। তবে এটা সাধারণত ৭০-৮০ বছর বয়সীদের হয়।

গ্লুকোমা কেন হয়?

আপনার চোখ একটা তরল পদার্থ তৈরি করে, যেটা টিস্যুকে পুষ্ট করে। সাধারণত এই তরল পদার্থটি ড্রেইনেজ এঙ্গেল নামে একটি চ্যানেল দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই চ্যানেলটা যখন ঠিকমতো কাজ করে না, তখন তরল পদার্থগুলো ঠিক মতো প্রবাহিত হতে না পেরে আটকা পড়ে যায় এবং আপনার চোখে চাপ দেয়া শুরু করে। এই অবস্থাকেই গ্লুকোমা বলে।

গ্লুকোমা হওয়ার ঝুঁকি যাদের বেশী

আপনার পিতা-মাতা, ভাই-বোন, কিংবা অন্য কোন নিকট আত্মীয়ের যদি এটা থাকে, তাহলে আপনার এটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া যেসব জিনিসের কারণে গ্লুকোমা হওয়ার সম্ভাবনা থাকেঃ

আপনার বয়স ৪০ এর বেশি
আপনার চোখে আঘাত লেগেছে, কিংবা অপারেশন করা হয়েছে
আপনার ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেশার, কিংবা হার্টে সমস্যা আছে
আপনার অপটিক নার্ভে সমস্যা আছে
আপনি স্টেরয়েড চোখের ড্রপ কিংবা পিল ব্যবহার করেছেন

ডাক্তাররা নিশ্চিত না গ্লুকোমা প্রতিরোধ করা সম্ভব কিনা। তবে নিয়মিত চোখের পরীক্ষা করলে এটা ধরে পড়ে যায়।

গ্লুকোমা এর প্রকারভেদ

সাধারণত চার ধরণের গ্লুকোমা মানুষকে আক্রান্ত করে। সবচেয়ে কমন হচ্ছে open-angle গ্লুকোমা

Open-Angle গ্লুকোমাঃ গ্লুকোমা হওয়া ৯০% মানুষের open-angle গ্লুকোমা হয়। এটাকে open-angle বলা হয়, কারণ এতে ড্রেইনেজ চ্যানেলে একটা স্পষ্ট ফাকা থাকে যার ভেতরে চোখের তৈরি করা তরল পদার্থ আটকা পড়ে। এটা খুব আস্তে আস্তে হয়। প্রথম প্রথম আপনি কোন লক্ষণ নাও বুঝতে পারেন।

Angle-Closure গ্লুকোমাঃ এটা খুব দ্রুত হয় এবং হলে সাথে সাথে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। যাদের ড্রেইনেজ চ্যানেল সম্পূর্ণ বন্ধ না হয়ে অল্প একটু ফাকা থাকে, তাদের সাধারণত এটা হয়। ড্রেইনেজ চ্যানেলে অল্প একটু ফাকা থাকার কারণে চোখের ভিতরে দ্রুত প্রেশার বাড়া শুরু হয় এবং একটু পড়ে চোখ দিয়ে তরল পদার্থ বের হওয়া শুরু হয়।

যদি আপনার চোখে তীব্র ব্যাথা হয়, মাথা ব্যাথা, বমি বমি ভাব, কিংবা চোখ দিয়ে দেখতে সমস্যা হয়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করেন। ডাক্তার অপারেশনের মাধ্যমে আপনার ড্রেইনেজ চ্যানেলের মুখ খুলবেন। যদি দ্রুত ডাক্তারের কাছে না যান, তাহলে দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারেন।

Normal-Tension গ্লুকোমাঃ যদি আপনার এই ধরণের গ্লুকোমা হয়, তাহলে আপনার চোখে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চাপ পড়ে না। তবুও আপনার অপটিক নার্ভের ক্ষতি হতে পারে। কিজন্য এটা হয়, তা নিয়ে ডাক্তাররা নিশ্চিত না। ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তারের আপনার চোখের উপর চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে কমানোর চিকিৎসা করবেন।

Congenital গ্লুকোমাঃ এটা অত্যন্ত বিরল এবং সাধারণত ছোট বাচ্চাদের হয়। গর্ভে থাকার সময় যদি ড্রেইনেজ ক্যানাল ঠিকমত বিকশিত না হয়, তাহলে এই সমস্যা হয়। এটা হলে বাচ্চার চোখ অস্পষ্ট হয়ে থাকে এবং চোখ দেখতে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় মনে হয়। অপারেশন করে এই সমস্যা ঠিক করে ফেলা যায়। অধিকাংশ সময়ই যদি দ্রুত এটার চিকিৎসা করে ফেলা হয়, তাহলে সারা জীবন স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি থাকে।

গ্লুকোমা এর লক্ষণ

Open-angle গ্লুকোমা এবং normal-tension গ্লুকোমা আস্তে আস্তে কয়েক বছর ধরে হয়। তাই কোন লক্ষণ সাধারণত প্রথম প্রথম বোঝা যায় না। একারণে অধিকাংশ মানুষ বুঝতে পারে না যে তাদের গ্লুকোমা আছে। এটা সাধারণত ডাক্তারের কাছে চোখের পরীক্ষা করার সময় ধরা পড়ে।

যদি কোন লক্ষন দেখা দেয়, তাহলে আপনি চোখ দিয়ে ঝাপসা ঝাপসা দেখবেন অথবা উজ্জল আলোর উপরে রাঁধুনি-রঙ্গিন বৃত্ত দেখবেন। এটা সাধারণত দুই চোখেই হয়, তবে এক চোখে বেশি হতে পারে।

মাঝে মাঝে গ্লুকোমা খুব দ্রুত হতে পারে। তখন এসব লক্ষন দেখা দিতে পারেঃ

চোখে তীব্র ব্যাথা
মাথা ব্যাথা
বমি বমি ভাব
চোখ লাল হয়ে যাওয়া
আলোর পাশে বৃত্ত দেখা
ঝাপসা দৃষ্টি

যদি চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে আপনি আপনার পেরিফেরাল (সাইড) দৃষ্টিশক্তি হারাবেন। তারমানে যেসব জিনিস সাধারণত চোখের কোনা দিয়ে দেখেন, সেগুলো দেখতে পারবেন না।

গ্লুকোমা নির্নয়ের পরীক্ষাঃ

গ্লুকোমা ধরার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে নিয়মিত চোখের পরীক্ষা করা। আপনার গ্লুকোমা হয়েছে কিনা তা বোঝার জন্য ডাক্তার সাধারণত নিচের কয়েকটা কিংবা সবগুলো পরীক্ষা করবেনঃ

Eye pressure test: এই টেস্টে tonomete নামক একটা যন্ত্র ব্যবহার করে আপনার চোখের ভিতরে কতটুকু চাপ পড়ছে তা মাপা হয়। প্রথমে ডাক্তার আপনার চোখে একটা পেইনকিলিং ঔষধ দিবেন। এরপর আপনার চোখে লাইট ধরে tonomete দিয়ে আপনার চোখে আস্তে আস্তে চাপ দিবেন।

Gonioscopy: আপনার কোন ধরণের গ্লুকোমা আছে, তা বোঝার জন্য এই পরীক্ষা করা হয়। এটাতে ডাক্তার আপনার ড্রেইনেজ চ্যানেল খোলা নাকি বন্ধ তা পরীক্ষা করবেন।

Visual field test: এই পরীক্ষায় আপনি চোখের সব জায়গা দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন কিনা ডাক্তার তা পরীক্ষা করবেন। আপনাকে কয়েকটা লাইট স্পট দেখানো হবে এবং জিজ্ঞাসা করা হবে আপনি কোনগুলো দেখতে পাচ্ছেন। কিছু কিছু একেবারে আপনার দৃষ্টির শেষ সীমায় থাকবে। অধিকাংশ সময় গ্লুকোমা হলে আপনি ওগুলো দেখতে পাবেন না।

Optic nerve assessment: যেহেতু গ্লুকোমা হলে আপনার অপটিক নার্ভের ক্ষতি হতে পারে, তাই ডাক্তার আপনার অপটিক নার্ভ ভালো আছে কিনা সেটার পরীক্ষা করতে পারেন। এই পরীক্ষার চোখের একটি ড্রপ ব্যবহার করে আপনার চোখের তারাকে বড় করা হয়।

এরপর slit lamp (উজ্জল আলোযুক্ত একটি অণুবীক্ষণ যন্ত্র) কিংবা optical coherence tomography (একটা বিশেষ আলোর রশ্মি দিয়ে আপনার চোখকে স্ক্যান করে চোখের ছবি প্রিন্ট করা হয়) ব্যবহার করে আপনার অপটিক নার্ভ পরীক্ষা করা হয়।

যদি চোখের সাধারণ পরীক্ষার সময় আপনার গ্লুকোমা ধরা পরে, তাহলে আপনাকে একজন বিশেষজ্ঞ (ophthalmologist) এর কাছে আরো টেস্ট করার জন্য পাঠানো হতে পারে। Ophthalmologist আপনার গ্লুকোমা কতটুকু ছড়িয়েছে, আপনার চোখের কতটুকু ক্ষতি করেছে, এবং এটা হওয়ার কারণ পরীক্ষা করবেন।

গ্লুকোমা এর চিকিৎসা

দৃষ্টিশক্তি নিয়ে আপনার যদি কোন উদ্বেগ থাকে তাহলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। যদি আপনার গ্লুকোমা থাকে, তাহলে দ্রুত চিকিৎসা করলে এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যদি দ্রুত চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে আপনি আপনার দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারেন।

গ্লুকোমা এর কমন চিকিৎসা সমুহ হচ্ছেঃ

ঔষধঃ গ্লুকোমা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ডাক্তার আপনাকে চোখের ড্রপ কিংবা পিল দিতে পারেন। এগুলো আপনার চোখের তরল পদার্থ তৈরি করা কমিয়ে দিবে। যদি ডাক্তার আপনাকে ঔষধ দেয়, তাহলে তা নিয়মিত ব্যবহার করুন। ঔষধ ব্যবহার করার কারণে যদি আপনার কোন সাইড ইফেক্ট যেমন চোখ জ্বলা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, ইত্যাদি দেখা দেয়, তাহলে ডাক্তারকে জানান।

লেজার সার্জারিঃ Open-angle গ্লুকোমা ভালো করার জন্য ডাক্তার আপনাকে laser trabeculoplasty নামক একটা চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারেন। এটাতে ডাক্তার আপনার চোখকে অবশ করে লেজার বীম এর সাহায্যে আপনার ড্রেইনেজ চ্যানেলে ছোট একটা ছিদ্র করবেন। এটা সাধারণত প্রথমত এক চোখে এবং পরে আরেক চোখে করা হয়। লেজার সার্জারির কারণে আপনার চোখের উপর চাপ কমে যায়। তবে এটা কতদিন থাকবে তা বলা সম্ভব না। দীর্ঘ-মেয়াদি ফলাফল পেতে কারো কারো এটা কয়েকবার করা লাগতে পারে।

সার্জারিঃ যদি ঔষধ এবং লেজার সার্জারি দিয়ে আপনার সমস্যা ভালো না হয়, তাহলে ডাক্তার আপনাকে trabeculectomy নামক একটা চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারেন। এটাতে ডাক্তার আপনার চোখের সাদা অংশে একটা ছিদ্র করবেন যেটা দিয়ে তরল পদার্থ বের হতে পারে। এটা করার পড়ে অধিকাংশ মানুষের গ্লুকোমা এর কোন ঔষধ খেতে হয় না। তবে কিছু কিছু মানুষের এই ছিদ্র বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং আবার আরেকবার সার্জারি করা লাগতে পারে।

সময়মতো চিকিৎসা করা না হলে গ্লুকোমা অন্ধত্বের কারন হতে পারে
সময়মতো চিকিৎসা করা না হলে গ্লুকোমা অন্ধত্বের কারন হতে পারে
আপনার দৃষ্টিশক্তি রক্ষা করুন

গ্লুকোমা থাকা প্রচুর মানুষ জানে না যে তাদের এই সমস্যা আছে। যেহেতু চোখের পরীক্ষায় এটা ধরা পড়ে যায়, সেহেতু প্রতি দুই বছর পর পর একবার আপনার চোখের পরীক্ষা করুন।

এছাড়া আপনার পরিবারের কারো গ্লুকোমা আছে কিনা দেখুন। যদি থাকে তাহলে আপনার এটা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই আপনার উচিত ঘন ঘন চোখের পরীক্ষা করা।

যদি ডাক্তার বলে যে আপনার গ্লুকোমা আছে, তাহলে তিনি যা বলেন, তা করুন। যদি আপনার চোখের কোন পরিবর্তন হয়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারকে জানান।

Glaucoma bangla video